সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাংলাদেশ সফরের ভিত্তিহীন দাবিতে জাল নথি প্রচার

একটি নতুন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে বৈঠক করার জন্য আমেরিকার সাবেক কূটনীতিক বাংলাদেশে ছিলেন দাবি করে প্রমাণ হিসেবে বিমানবন্দরের একটি ভুয়া নথি অনলাইনে ছড়ানো হয়েছে। কথিত বৈঠক ঘিরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মার্কিন হস্তক্ষেপের অভিযোগও তোলা হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীতে বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন কর্মকর্তার তথ্য মতে, পিটার হাস ৫ আগস্ট ২০২৫ তারিখে ওয়াশিংটনে ছিলেন।

৬ আগস্ট ২০২৫ তারিখের প্রথম প্রহরে একটি ফেসবুক পোস্টে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারকারী যাত্রীদের একটি তালিকার ছবি ছড়ানো হয়। 

কথিত তালিকাটিতে ৫ আগস্ট, মার্কিন সাবেক কূটনীতিক পিটার হাসের নাম এবং তিনি ব্যবহার করেছেন বলে একটি ফ্লাইটের নাম উল্লেখ করে হাইলাইট করে দেয়া হয়েছে।

পিটার হাস ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ছবিটির ক্যাপশনের একটি অংশে বলা হয়, "পিটার হাস আজ ০৫ আগস্ট ২০২৫ তারিখে সন্ধ্যা 19:10 মিনিটের সময় Emirates EK 583 Flight এ করে যাত্রা করার পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশই ছিলো।" 

"অথচ NCP বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জানিয়েছে যে, পিটার হাস আমেরিকায় আছে; কি চরম মিথ্যাচার ও ভয়ংকর অবস্থা আমাদের গণমাধ্যমের, ছি!"

এনসিপি হচ্ছে ২০২৪ সালের আগস্টে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থীদের অনেককে নিয়ে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল(আর্কাইভ লিংক এখানএখানে)।

Image
লাল ক্রস চিহ্নসহ ১০ আগস্ট ২০২৫ তারিখে নেয়া অসত্য ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট

অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের দিন পিটার হাসের সাথে বৈঠক করার জন্য এনসিপির চার নেতা ৫ আগস্ট কক্সবাজারের একটি হোটেলে গিয়েছেন বলে স্থানীয় একটি টেলিভিশন চ্যানেল দাবি করার পর ছবিটি ফেসবুক এবং এক্স পোস্টেও ছড়ানো হয় (আর্কাইভ লিংক এখানেএখানে)।

কথিত বৈঠক এবং অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের দিনে এনসিপি নেতাদের বিনোদন ভ্রমন ব্যাপকভাবে সমালোচনার সৃষ্টি করে। কেউ কেউ কথিত এই বৈঠককে হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার ইঙ্গিত হিসাবে দেখেছেন (আর্কাইভ  লিংক)।

তবে একাধিক সূত্রের মতে, কথিত বৈঠকের সময় হাস ওয়াশিংটনে ছিলেন।

ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা ৫ আগস্ট ফেসবুকে এক বিবৃতিতে গুজবটি অস্বীকার করেছেন (আর্কাইভ লিংক)।

ফেসবুক পোস্টে মোর্তোজা লিখেন, "ছবি যে দুইজন তুলছেন তাদের একজন পিটার হাস,বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত। যিনি আজ (ওয়াশিংটন সময় সকাল ৯ টা, ৫ আগষ্ট ২০২৫) সকালেও ইউএসএ’তে অবস্থান করছেন। ছবিটি গত শুক্রবারের।"

পিটার হাসের বর্তমান কর্মস্থল মার্কিন প্রতিষ্ঠান এক্সেলেরেট এনার্জির একজন প্রতিনিধি, পৃথকভাবে এএফপিকে বলেছেন যে, তিনি ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসের পর বাংলাদেশে ভ্রমণ করেননি।

অন্যদিকে এনসিপি নেতা নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছেন: "পিটার হাসের সাথে আমাদের বৈঠকের বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রচারিত খবরটি একটি গুজব এবং ভিত্তিহীন" (আর্কাইভ লিংক)।

জাল ভিআইপি তালিকা

ঢাকা বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক এস এম রাগীব সামাদ এএফপিকে বলেন, কথিত ভিআইপি তালিকাটি “সম্পূর্ণ ভুয়া”(আর্কাইভ লিংক)।

ছড়ানো ছবিটি বিশ্লেষণে বেশ কিছু তথ্যগত ত্রুটি পাওয়া গেছে, যা ছবিটিকে জাল বলে ইঙ্গিত দেয়। 

কথিত তালিকায় বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের অফিসিয়াল বাংলা নাম ব্যবহার করা হয়নি। তালিকায় "বেসামরিক" এর পরিবর্তে "বেসরকারি" শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে (আর্কাইভ লিংক)।

নথিতে বিমান নিরাপত্তার তত্ত্বাবধানকারী একজন সহকারী পরিচালক হিসেবে “শারিয়ার চৌধুর” নামে একজনের স্বাক্ষরও রয়েছে। তবে বিমানবন্দরের কর্তাদের তালিকায় এমন কোনও ব্যক্তির নাম নেই (আর্কাইভ লিংক)।

ফ্লাইট ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট ফ্লাইটঅ্যাওয়্যার অনুসারে, এমিরেটসের ফ্লাইট ৫৮৩ দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে ৫ আগস্ট সকাল ১০টা ৫২ মিনিটে ঢাকা ছেড়েছিল। যদিও অসত্য পোস্টে ফ্লাইটি সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটে ছেড়েছিল বলে দাবি করা হয় (আর্কাইভ লিংক)।

https://www.flightaware.com/live/flight/UAE583/history/20250805/0425Z/VGHS/OMDB

https://perma.cc/2BBE-BJ9L

Image
অসত্যভাবে ছড়ানো ছবি (বামে) এবং ফ্লাইটঅ্যাওয়্যারের ফ্লাইট রেকর্ডে (ডানে) বহির্গমন সময়ের মধ্যে অসঙ্গতি চিহ্নিত করে তুলনামূলক স্ক্রিনশট

নথিতে তালিকাভুক্ত অন্যান্য ফ্লাইটের সাথেও অসঙ্গতি রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ফ্লাইদুবাইয়ের ফ্লাইট ৫০২ সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে ছেড়ে গেছে বলে তালিকাভুক্ত করা হলেও বাস্তবে এটি সকাল ৮টা ১৫মিনিটে ঢাকা ছেড়েছিল (আর্কাইভ লিংক)।

নথিতে ভুল বানান এবং ভুল পদবিও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীকে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। যদিও তাকে ২২ মে ২০২২ তারিখে অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়েছিল (আর্কাইভ লিংক)।

এএফপি এর আগেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ঘিরে ছড়ানো অন্যান্য অপতথ্য খণ্ডন করেছে।

এমন কোনো কন্টেন্ট আছে যা আপনি এএফপি’কে দিয়ে ফ্যাক্ট চেক করাতে চান?

আমাদের সাথে যোগাযোগ