টাইফয়েডের টিকাদান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ভিত্তিহীন দাবি প্রচার

অক্টোবর মাসের ১২ তারিখ থেকে দেশে টাইফয়েডের টিকাদান কর্মসূচি শুরু করেছে সরকার। তবে ইউনিসেফের একজন স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে শিশুদের টাইফয়েড টিকা দেওয়া সম্পর্কে অনলাইনে ছড়ানো অপতথ্যের কারণে দেশব্যাপী সম্ভাব্য মারাত্মক এই রোগের টিকাদান কর্মসূচি পিছিয়ে পড়ছে। বাংলাদেশে ব্যবহৃত টাইফয়েডের টিকার মাধ্যমে শিশুর শরীরে “এই রোগের জীবাণু” ঢোকানো হয় বলে অনলাইনের এসব পোস্টে অসত্যভাবে দাবি করা হয়। কিন্তু একজন সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ বলেছেন, টিকাটি একটি ঝুঁকিহীন ভাইরাস ব্যবহার করে, যা টাইফয়েড সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার বৈশিষ্ট্যের অনুকরণ করে শরীরে একটি অ্যান্টিবডি তৈরি করে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলেছে যে, টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচি “অকাল মৃত্যু রোধে অত্যন্ত নিরাপদ এবং কার্যকর সমাধান।” 

১৪ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে ছড়ানো একটি ফেসবুক পোস্টের ক্যাপশনে বলা হয়, “আমি অভিভাবকদের অনুরোধ করবো, এই বিনামূল্যে ভ্যাকসিন আপনার আদরের বাচ্চার শরীরে মোটেও প্রবেশ করাবেন না। এগুলো থেকে দূরে থাকুন।” 

 তিন হাজারের বেশি  শেয়ার হওয়া পোস্টটিতে আরও বলা হয়, “আসলে টিকা হচ্ছে ঐ রোগের জীবাণুর একটি অংশ বিশেষ।”

পোস্টের ক্যাপশনে আরও বলা হয় যে, এই ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অজানা, এবং টাইফয়েড জ্বরের চিকিৎসা থাকার সত্ত্বেও টিকা দেওয়া প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।

Image
এএফপির যোগ করা লাল ক্রস চিহ্নসহ ৫ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে নেয়া অসত্য পোস্টের স্ক্রিনশট

সরকার সারাদেশে ৯ মাস থেকে ১৫ বছর বয়সী ৫ কোটি শিশুকে সালমোনেলা টাইফি জনিত কারণে টিকা-প্রতিরোধযোগ্য সংক্রামক রোগ--- টাইফয়েড জ্বর প্রতিরোধে টিকাদান কর্মসূচি শুরু করার কয়েক দিন পর একই অসত্য দাবিতে পোস্টটি ফেসবুকে অন্যত্র শেয়ার করা হয়(আর্কাইভ লিংক)।

বাংলাদেশে এই রোগে মৃত্যুর প্রায় ৬৮ শতাংশই শিশু। গ্যাভি ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্সের মতে, অন্যান্য নিম্ন-আয়ের দেশের মতো বাংলাদেশেও টাইফয়েড জ্বর জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য হুমকি।

এর আগে পোলিওর বিরুদ্ধে টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ সফলতা অর্জন করেছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশকে পোলিও মুক্ত ঘোষণা করা হয়(আর্কাইভ লিংক)। এছাড়া ২০২৪ সালে মেয়েদেরকে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশ ৯৩ শতাংশ সফলতা অর্জন করেছে। ভাইরাসটি জরায়ুমুখের ক্যান্সার সৃষ্টি করে থাকে(আর্কাইভ লিংক)। 

কিন্তু অসত্য পোস্টগুলো টিকাদান কর্মসূচিতে ব্যবহৃত টাইফিবেভ টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে(আর্কাইভ লিংক)।

একজন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী বলেন, “যদি এটাই হয়, তাহলে সরকার কেন এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করছে না? সাধারণ মানুষকে আবার বিভ্রান্ত করবেন না।”

আরেকজন বলেন: “এটা সত্য, আমার পরিবারের কেউ টিকা নেয়নি।” 

টিকাদান অভিযানের অংশ হিসেবে মাঠে থাকা জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফের স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মকর্তা রিয়াদ মাহমুদ এএফপিকে বলেন, টিকা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো অপতথ্যের কারণে গ্রামীণ অঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে টিকা গ্রহণের হার কমেছে।

মাহমুদ বলেন, রাজধানী ঢাকায় এই হার ৭০ শতাংশ, যেখানে গ্রামাঞ্চলে এই হার ৮৫ শতাংশ।

৫ নভেম্বর তিনি এএফপিকে বলেন, “শহরে কম হারের কারণ সোশ্যাল মিডিয়ায় নেতিবাচক প্রচারণা। অপতথ্য অনেক অভিভাবককে বিভ্রান্ত করেছে।”

তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভ্যাকসিনটিকে নিরাপদ বলে মনে করেছে  এবং অনলাইনে ছড়ানো অসত্য দাবি মতো এটি সালমোনেলা টাইফি ব্যাকটেরিয়া দিয়ে তৈরি করা হয়নি।

নিরাপদ, কার্যকর সমাধান 

টাইফিবেভ ভ্যাকসিন ২০২০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে প্রিকোয়ালিফিকেশন অর্জন করে। তাদের একটি পাবলিক অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট অনুসারে, “টিকার নিরাপত্তা প্রোফাইল সন্তোষজনক বলে মূল্যায়ন করা হয়েছিল”(আর্কাইভ লিংক)।

ইউনিসেফের এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি ডা. আহমেদ জামশিদ মোহাম্মদ বলেন, টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন “একক ডোজ, অত্যন্ত নিরাপদ এবং অকাল মৃত্যু রোধে কার্যকর সমাধান”(আর্কাইভ লিংক)

এছাড়া,  ২৮ অক্টোবর সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. তাজুল ইসলাম বারী এএফপিকে বলেন, টাইফিবেভ টিকা সালমোনেলা টাইফি ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে তৈরি করা হয় না। বরং, টিকাটি অ্যান্টিবডি তৈরির জন্য একই বৈশিষ্ট্যযুক্ত একটি ঝুঁকিহীন ভাইরাস, সিট্রোব্যাক্টর ফ্রেউন্দি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। 

বাংলাদেশের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) প্রাক্তন প্রোগ্রাম ম্যানেজারও টাইফয়েড টিকাদানের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেছেন। 

“যেহেতু জীবনযাত্রার ধরণ আমাদেরকে এখন বিভিন্ন ওষুধ খেতে বাধ্য করে, তাই ভাইরাসটি এখন পরিবর্তিত হয়েছে। আমাদের শরীর এখন আরও বেশি অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী, যার ফলে মুখে খাওয়ার ওষুধ অনেক ক্ষেত্রে সবসময় কাজ করে না।” 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে এই ভ্যাকসিনের প্যাকেজ ইনসার্টে বলা হয়েছে যে, টিকার সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে ইনজেকশনের স্থানে ব্যথা, ফোলা ভাব এবং লাল হওয়া, পাশাপাশি সাধারণ ক্লান্তি এবং জ্বর হয়ে থাকতে পারে (আর্কাইভ লিংক)। 

এএফপি এর আগেও টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে ছড়ানো একই ধরণের অসত্য দাবি খণ্ডন করেছে।

এমন কোনো কন্টেন্ট আছে যা আপনি এএফপি’কে দিয়ে ফ্যাক্ট চেক করাতে চান?

আমাদের সাথে যোগাযোগ