এটি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো কর্তৃক পর্তুগালের সাংবাদিকের মাইক্রাফোন কেড়ে নেয়ার দৃশ্য

গত ৭ আক্টোবর ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরু পর থেকে ইসরায়েল কিংবা ফিলিস্তিনের পক্ষে তারকাদের সমর্থন নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্যের জোয়ার তৈরি হয়েছে। এমনই একটি বিভ্রান্তিকর তথ্যের উদাহরণ পর্তুগালের তারকা ফুটবল ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর একটি ভিডিও যা সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে অসত্যভাবে দাবি করা হয়েছে যে, ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়ে রোনালদো এক ইসরায়েলি সাংবাদিকের মাইক্রোফোন কেড়ে নিয়ে পানিতে ছুঁড়ে ফেলেছেন। প্রকৃতপক্ষে, রোনালদোর এই ক্ষুব্ধ আচরণটি চলমান যুদ্ধ শুরুর কয়েক বছর আগে ২০১৬ সালের ঘটনা, এবং যে সাংবাদিকের মাইক্রোফোন কেড়ে নেয়া হয় তিনি ছিলেন পর্তুগালের।

গত ১২ অক্টোবর,২০২৩ ফেসবুকে এখানে আপলোড করা একটি পোস্টের শিরোনামে বলা হয়: "রোনালদো একমাত্র ফুটবলার যে কিনা ফিলিস্তিনের পক্ষে সব সময় সোচ্চার। স্যালুট তোমাকে।"

২,০০০ বারের বেশি ভিউ হওয়া ভিডিওটিতে দেখা যায়, একজন সাংবাদিক ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে ইন্টারভিউ করার চেষ্টা করছেন আর তখনই পর্তুগালের ফুটবলার ওই সাংবাদিকের মাইক্রােফােন কেড়ে নেন এবং পানিতে ছুঁড়ে ফেলেন।

এরপর ৪৭ সেকেন্ডের ভিডিও ক্লিপটিতে রোনালদোকে সাংবাদ সম্মেলন চলাকালে টেবিলের উপর থেকে কোকের বোতল সরিয়ে স্বচ্ছ পানির বোতল রাখতে দেখা যায়। এছাড়া ফুটেজটিতে ম্যাচ পরবর্তী পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের দুটি ক্লিপে দু'জন অতিথির সাথে রোনালদো হ্যান্ডশেক না করে এগিয়ে যেতে, ফুটবল জার্সি উপরের দিকে টেনে তুলে 'সেইভ প্যালেস্তাইন' নামে অন্য একটি টি-শার্ট প্রদর্শন, 'আই লাভ গাজা এ্যান্ড ইউ?' ও স্প্যানিশ ভাষায় লেখা "টুডুস কন প্যালেস্তাইন, অর্থাৎ সবাই ফিলিস্তিনের সাথে" লিখা প্ল্যাকার্ড এবং ফিলিস্তিনে স্কার্ফ পড়া তার একটি ছবি দেখা যায়।

একই দাবিতে ভিডিওটি ফেসবুকে এখানে এবং টিকটকে এখানে ছড়ানো হয়।

গত ৭ অক্টোবর হামাস মিলিট্যান্টরা ইসরায়েলে আক্রমণ করার পর থেকে ভিডিওটি ছড়ানো শুরু হয়। ওই হামলায় প্রায় ১২০০জন নিহত হন এবং ২৪০ জনকে জিম্মি করে হামাস, যাদের অধিকাংশ বেসামরিক লোক বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা।

জবাবে ইসরায়েল হামাসের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে। এতে কয়েক হাজার শিশুসহ প্রায় ১৭,০০০ লোক নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে গাজা উপত্যকায় হামাস পরিচালিত সরকার।

২০১৬ এর সংক্ষুব্ধ আচরণ

গুগলে কীওয়ার্ড সার্চে মূল ভিডিওটি খুঁজে পায়, যেখানে ২০১৬ সালে ফ্রান্সে ইউরো টুর্নামেন্ট চলাকালে পর্তুগালের টিমের মর্নিং ওয়াকের সময় পর্তুগালের সম্প্রচার চ্যানেল সিএমটিভি'র রিপোর্টার ডিয়োগো টরেসকে রোনালদোর সাক্ষাৎকার নিতে দেখা যায়।

প্রকৃত ভিডিওটি ২০১৬ সালের ২২ জুন 'সিএমটিভি' এবং ফুটবল নিউজ সংক্রান্ত সংবাদমাধ্যম 'গোল'সহ বিভিন্ন মিডিয়া চ্যানেল প্রকাশ করে (আর্কাইভ লিংক এখানে এবং এখানে)।

নিচে অসত্য দাবিতে ছড়ানো ভিডিও (বামে) এবং ২০১৬ সালে 'গোল' প্রকাশিত সিএমটিভি ভিডিওর(ডানে) তুলনামূলক স্ক্রিনশট দেয়া হল:

Image

সিএমটিভি জানিয়েছে, টরেস রোনালদোকে জিজ্ঞেস করেছিলেন :"আপনি এই ম্যাচের জন্য প্রস্তুত কি না?" তখন ফুটবল তারকা মাইক্রােফোনটি কেড়ে নিয়ে জলাশয়ের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলেন।

রিপোর্টারের লাল রংয়ের মাইক্রোফোনে সিএমটিভি'র লোগোটিও দৃশ্যমান (আর্কাইভ লিংক)।

২০১৬ সালের জুলাই -এ সিএমটিভি এবং ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড 'দ্য মিরর' -এর প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুইজন ডুবুরি লেক থেকে মাইক্রোফোনটি উদ্ধার করে দাতব্য কাজের জন্য নিলামে তোলার পরিকল্পনা জানান (আর্কাইভ লিংক এখানে এবং এখানে)।

নিচে সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো ভিডিওতে দৃশ্যমান মাইক্রোফোন (বামে), জলাশয় থেকে উদ্ধারের পর মাইক্রোফোনের (মাঝে) এবং সিএমটিভির (ডানে) তুলনামূলক স্ক্রিনশট দেয়া হল:

Image

ব্রিটিশ সাংবাদিক ড্যান ওয়াকার ২০১৬ সালে তার বই "ম্যাজিক, মাড অ্যান্ড ম্যারাডোনা" এ রোনালদোর এই ক্ষুব্ধ আচরণ সম্পর্কে লিখেছেন যেখানে তিনি টরেসকে পর্তুগালের সাংবাদিক হিসেবে বর্ণনা করেন, ইসরায়েলি নয় (আর্কাইভ লিংক)।

ওই ঘটনা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে এখানে এবং এখানে করা প্রতিবেদনেও তাকে পর্তুগালের রিপোর্টার হিসেবে বর্ণনা করা হয় (আর্কাইভ এখানে এবং এখানে)।

রোনালদোর ফটো

এদিকে ভিডিওর একটি দৃশ্যে রোনালদোকে তার ফুটবল জার্সি তুলে একটি "সেভ প্যালেস্টাইন" লিখা টি-শার্ট প্রকাশ করতে দেখা যায়।

গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চে মূল ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়, যা ২০১০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এএফপি প্রকাশ করে। ওই ছবিতে রোনালদোর টি-শার্টে "মাদেইরা" শব্দটি দেখায়।

ছবির ক্যাপশনে বলা হয়: "২০১০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাদ্রিদে সান্তিয়াগো বার্নাবেউ স্টেডিয়ামে স্প্যানিশ লিগ ফুটবল খেলার সময় ভিলারিয়ালের বিপক্ষে গোল করার পর উদযাপন করতে গিয়ে রিয়াল মাদ্রিদের পর্তুগিজ ফরোয়ার্ড ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো তার জার্সি তুলে তার শার্টে লিখা মাদেইরা দ্বীপের নাম প্রদর্শন করেছেন।"

এএফপি তখন প্রতিবেদন করে প্রকাশ করে যে, রোনালদো তার গোলটিকে মাটি ধ্বসের কবলে পড়া তার জন্মভূমি মাদেইরা দ্বীপের জন্য উৎসর্গ করে।

নিচে অসত্য দাবিতে ছড়ানো ভিডিওর বিকৃত ফুটেজ (বামে) এবং এএফপি ফোরামের ওয়েবসাইটে মূল ছবির (ডানে) তুলনামূলক স্ত্রিনশট দেওয়া হল:

Image

এছাড়া ভিডিওর একটি দৃশ্যে রোনালদোকে স্প্যানিশ ভাষায় "প্যালেস্টাইনের সাথে সবাই" লেখা একটি প্ল্যাকার্ড প্রদর্শনের ছবিটিও বিকৃত।

কীওয়ার্ড সার্চে মূল ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়, যা ২০১৮ সালের ১৮ মে দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস প্রকাশ করেছে (আর্কাইভ লিংক)।

ছবিতে দেখা যায়, ভূমিকম্পে আঘাত হানা স্পেনের শহর লোরকা পরিদর্শনের সময় পর্তুগিজ ফুটবলারকে "লোরকার সাথে সবাই" লেখা একটি প্ল্যাকার্ড ধরে পোজ দিচ্ছেন।

এএফপিও একই দিনে ধারণ করা একটি ছবি প্রকাশ করে, যেখানে দেখা যায় রোনালদো টোগোলিজ ফুটবলার এমানুয়েল আদেবায়োরের পাশে দাঁড়িয়েছেন, যিনি একই ধরনের প্ল্যাকার্ড ধরে ছিলেন।

নিচে অসত্য দাবিতে ছড়ানো পোস্টে বিকৃত ছবি (বাম) এবং অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের ছবির (ডান দিকে) একটি তুলনামূলক স্ক্রিনশট দেয়া হল:

Image

বিভ্রান্তিকর দাবিতে পুরনো ভিডিও প্রচার

তবে ভিডিওর ২৩ সেকেন্ডের দৃশ্যে রোনালদো এক দিক থেকে অন্য দিকে ঘুরে যাওয়াকে ইসরায়েলের কর্মকর্তার সাথে হ্যান্ডশেক করতে অনাগ্রহের যে দাবি করা হয়েছে সেটি অসত্য।

গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চে ২০১৪ সালের ২২ ডিসেম্বর আপলোড করা একটি ইউটিউব চ্যানেলে ৪৩ সেকেন্ডের একটি ভিডিও পাওয়া যায়, যেখানে দেখা যায় রোনালদো বাম দিক থেকে ম্যাচ পরবর্তী পুরস্কার গ্রহণ করতে এসে, পুনরায় একই দিক দিয়ে ফিরে যেতে চান। তখন মঞ্চের একজন অতিথি তাকে বিপরীত দিকে (ডানে) যাওয়ার পথ দেখালে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ডান দিকে ফিরে যান।

মঞ্চে উঠে ট্রফি গ্রহণের আগে রোনালদোকে উপস্থিত সব অতিথির সাথে হ্যান্ডশেক করতে দেখা যায়।

নিচে বিভ্রান্তিকর দাবিতে ছড়ানো পোস্টের ফুটেজের (বামে) এবং ইউটিউবে ২০১৪ সালে আপলোড করা ভিডিওর(ডানে) তুলনামূলক স্ক্রিনশট দেয়া হল:

Image

এছাড়া, ভিডিওর ৪৭ সেকেন্ডে দেখা যায়, পুরস্কার বিতরণী মঞ্চের একজন অতিথি হাত বাড়িয়ে দিলেও রোনালো হ্যান্ডশেক না করে চলে যাচ্ছেন। ফুটেজটি শেয়ার করে অসত্যভাবে দাবি করা হচ্ছে যে, হাত বাড়িয়ে দেয়া লোকটি ইহুদি বলে রোনালদো তার সাথে হ্যান্ডশেক করেননি।

তবে গুগল রিভার্চ ইমেজ সার্চে একই ভিডিও 'এক্স (পূর্বের টুইটারে) খুঁজে পাওয়া যায়। এতে বলা হয় যে, ঘটনাটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ইতালিয়ান সুপার কাপে লাজিও বনাম জুভেন্টাসের মধ্যকার ম্যাচ পরবর্তী পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের। যে ম্যাচে জুভেন্টার্স ৩-১ গোলে পরাজিত হয়। জুভেন্টাসকে জয় এনে দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি তরিগরি গলার মেডেলটি খুলে ফেলেন।

বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও এখানে এবং এখানে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

বিভ্রান্তিকর দাবিতে ছড়ানো ফুটেজে হাত বাড়ানো ব্যক্তির পোশাকের উপর ইসরায়েলের পতাকাসহ একটি "ইসরায়েলি প্রেস' নামে একটি লেখা গেলেও এক্স'র ভিডিওতে তেমন কোনো লেখা বা পতাকা দেখা যায়নি।

এএফপি অনুসন্ধান করে দেখেছে, ভিডিওটিতে হাত বাড়ানো ব্যক্তিটি ছিলেন ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সৌদি আরবে ইতালীয় রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী লুকা ফেরারি। এরপর তিনি চীনে ইতালির রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পান।

নিচে বিভ্রান্তিকর দাবিতে ছড়ানো ফুটেজের (বামে) এবং টুইটারে আপলোড করা মূল ভিডিওর (ডানে) তুলনামূরক স্ক্রিনশট দেয়া হল:

Image

এছাড়া ভিডিওর শেষ দিকে ফিলিস্তিন লেখা একটি স্কার্ফ গলায় জড়ানো দৃশ্য শেয়ার করে অসত্য দাবিতে লেখা হয়: "হি সাপোর্ট প্যালেস্তাইন।"

তবে গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চ করে ফেসবুকে ২০১০ সালের নভেম্বর ২৮ তারিখে আপলোড করা একটি ছবি খুঁজে পাওয়া যায়, যার ক্যাপশনে বলা হয়: " জুরিখ, ১২.১.২০০৯। স্পোটর্স, ফুটবল ইন্টারন্যাশনাল ফিফা ওয়ার্ল্ড প্লেয়ার গালা ২০০৮ ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো (পিওআর, বাম থেকে ২য়) এবং ফিলিস্তিন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সিব্রিল আল রাসুব (ডানদিকে) এবং দুই অধিনায়ক হানি থালসিয়েন এবং আহমেদ কাশকাস।"

আরো অনুসন্ধানে এএফপি ফোরামে ২০০৯ সালের ১২ জানুয়ারিতে প্রকাশিত ফিলিস্তিন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সিব্রিল আল রাসুবের একই ধরনের স্কাফ পরিহিত ছবি পাওয়া যায়।

এর ক্যাপশনে বলা হয়: "১২ জানুয়ারি ২০০৯-এ ফিফা প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটার ফিফা ওয়ার্ল্ড প্লেয়ার গালা ২০০৮ পুরষ্কার অনুষ্ঠানে ফিলিস্তিনি ফুটবল ফেডারেশনের প্রধান জিব্রিল রাজুবকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। ফিফার উদ্বোধনী উন্নয়ন পুরস্কার ফিলিস্তিনকে প্রদান করা হয়েছে। ২৬ অক্টোবর ২০০৮- সালে ফিলিস্তিন তাদের নতুন রাম স্টেডিয়াম উদ্বোধন করেন যেখানে একটি প্রযুক্তি কেন্দ্রও রয়েছে। এএফপি ফটো /ফ্যাব্রিস কফরিনি।"

তবে ফিলিস্তিনের সমর্থনে রোনালদো ওই স্কার্ফটি পড়েছেন বলে এমন কোন সূত্র পাওয়া যায়নি।

রোনালদোর ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করার বিষয়ে বিভিন্ন অসত্য দাবিতে ছড়ানো তথ্য খণ্ডন করে এএফপির করা আরো প্রতিবেদন পড়ুন এখানে এবং এখানে

এমন কোনো কন্টেন্ট আছে যা আপনি এএফপি’কে দিয়ে ফ্যাক্ট চেক করাতে চান?

আমাদের সাথে যোগাযোগ